চলমান করোনা সংকটকালে দেশব্যাপী অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম চলছে। এটা সরকারের খুবই দূরদর্শী এবং প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এর মাধ্যমে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে পাঠে সংযুক্ত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও এ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে মহা ব্যস্ততায় দিন কাটাচ্ছে। সরকারি হিসাবমতে, এসএসসি পর্যন্ত প্রায় ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। এইচএসসি পর্যায়েও এ সংখ্যা বেশি ছাড়া কম হবে বলে মনে হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে এ রকম দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করায় আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
তবে অ্যাসাইনমেন্টের বিষয় নির্ধারণ আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধার মাপকাঠির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। আমাদের শিক্ষার্থীরা কীভাবে সহজে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে পারে, অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তাদের সেদিকে নজর দেওয়া একান্ত জরুরি। ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের ২ নম্বর অ্যাসাইনমেন্টের শিরোনাম ছিল ‘ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সময় পরিক্রমা অনুযায়ী উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির সংক্ষিপ্ত বিবরণসহ একটি পোস্টার পেপার তৈরি করো।’

অ্যাসাইনমেন্টের শিরোনাম সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়
এ পোস্টার পেপার নিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টি হলো যত যন্ত্রণা! সাধারণত A4 সাইজের কাগজে অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে বলা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কী পোস্টার তৈরি করবে, পেপারের সাইজ কত হবে, পোস্টারে কী কী আঁকা লাগবে, নাকি শুধু লেখা লাগবে ইত্যাদি প্রশ্নের মারপ্যাঁচে ঘুরপাক খেতে লাগল।
আবার পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের ১ ও ২ নম্বর অ্যাসাইনমেন্টের নির্দেশক অংশের ‘ঙ’তে দেখা গেল ‘উপস্থাপন কৌশল’ নামক একটি নির্দেশক দিয়ে ৪ নম্বর বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ অংশ কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, তা নিয়েও শিক্ষার্থীদের শঙ্কা রয়েছে।
আমার মতে, ‘ঙ’ নির্দেশক এর আগে ‘ক, খ, গ এবং ঘ’ নির্দেশকে শিক্ষার্থীদের যে চারটি বিষয়ে লিখতে বলা হয়েছে, সেখানেই উপস্থাপনা কৌশল উঠে আসার কথা। তাহলে আলাদা উপস্থাপন কৌশল দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে? কেউ কেউ বলছেন, এখানে হাতের লেখা সুন্দর বা বিশ্রীর ওপর ভিত্তি করে ৪ নম্বরের মূল্যায়ন করতে হবে।
বিষয়টি আমার কাছে বোধগম্য নয়। বর্তমান যুগ কম্পিউটারের যুগ, ইন্টারনেটের যুগ। এ যুগে এমফিল, পিএইচডির মতো গবেষণাপত্র যেখানে প্রিন্ট কপি জমা দিতে হয়, সেখানে হাতের লেখার ওপর নম্বর দিয়ে প্রকৃত মেধাবীদের লেখা অবমূল্যায়নের নামান্তর।
আবার ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের প্রথম পত্রের ৩ নম্বর অ্যাসাইনমেন্টের শিরোনাম নিয়েও কিছু কথা বলার আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর মদিনা জীবনে ইসলাম প্রচারের সৃষ্ট সমস্যা ও এর সমাধানের ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করো।’ এ প্রতিবেদনের শব্দ নিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ল আরেক সমস্যায়।
সাধারণত এইচএসসি বাংলা দ্বিতীয় পত্রে একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে শিক্ষার্থীরা প্রতিবেদন লিখে অভ্যস্ত। এখন তারা উল্লিখিত বিষয়ের ওপর বাংলা দ্বিতীয় পত্রের প্রতিবেদনের ফরম্যাটে লিখবে নাকি অন্য কোনো উপায়ে লিখবে, তা নিয়েও বেশ দুশ্চিন্তায় রয়েছে! কয়েকজন তো প্রায় কান্নাকাটির মতো অবস্থা!
একদিন অ্যাসাইনমেন্ট প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের কলেজের অধ্যক্ষের করা একটি গল্প মনে পড়ে গেল। তিনি বাংলার শিক্ষক। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে কে কী করেছে, জানতে চেয়ে একটি চিঠি লিখতে বললেন। একজন শিক্ষার্থী নাকি লিখেছে, ‘খুব ভোরবেলায় আমি নদীর ঘাটে গিয়ে ফেরিতে উঠলাম।
সেখানে দেখলাম অনেক মানুষের আনাগোনা। কেউ কেউ মালামাল নিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ কেউ বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল পারাপার করছে ইত্যাদি ইত্যাদি।’
আমি একবার পরীক্ষায় প্রশ্ন দিয়েছিলাম, খোলাফায়ে রাশেদিন বলতে কী বোঝো? এক শিক্ষার্থী লিখেছে, ‘খালি পায়ে যারা চলাফেরা করে তাদের খোলাফায়ে রাশেদিন বলা হয়।’ আসলে আমাদের প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী এই মানের। তাদের মানের দিক চিন্তা করেই শিরোনাম করা জরুরি।
- আরও পড়ুনঃ অ্যাসাইনমেন্ট লেখার নিয়ম
মূলত ক্লাসের বাইরে যারা থাকে, তাদের বেশির ভাগ এ রকম উত্তরই দিয়ে থাকে। কিন্তু যারা ক্লাসে থাকে, বই পড়ে, তারা ঠিকই লিখতে পারে। করোনা সংকটের কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বাইরে। তা ছাড়া অনলাইন ক্লাস চালু থাকলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে প্রায় ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এর আওতায় এসেছে। অর্থাৎ আমাদের প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এর বাইরেই রয়ে গেছে। আমার কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৫০।
অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত থাকে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রায় ৫ শতাংশ। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিচ্ছে প্রায় ৯৩ শতাংশ। তাহলে বাকি ৮৮ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের কোনো দিকনির্দেশনা ছাড়াই অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করছে। ফলে অ্যাসাইনমেন্টের শিরোনাম বুঝতে না পেরে অনেকেই ইউটিউব দেখে অ্যাসাইনমেন্ট লিখছে। কিন্তু এই ইউটিউবে যারা কনেটন্ট আপলোড করছে, তাদের বেশির ভাগই কোনো শিক্ষক নয়। ফলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
মো. নাঈম নামের এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছে, ‘প্রতিবাদ জানাই, ১২-১৩ বছরের স্টুডেন্ট লাইফে এত প্যারা কখনো পাইনি! কী করব? কীভাবে করব? নির্দেশনা কী? কিছুই আমরা ঠিকভাবে জানি না। এই করোনার মধ্যে একদিকে অ্যাসাইনমেন্ট, সেই অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার পরে আবার শিরোনাম নিয়ে দুশ্চিন্তা।
হিসাববিজ্ঞানের অ্যাসাইনমেন্টের উত্তর লেখার পর এখন বলতেছে আবার প্রশ্ন ভুল, নতুন প্রশ্ন থেকে লিখতে হবে! একটা অ্যাসাইমেন্ট লিখতে কত কষ্ট তাঁরা বুঝবে কীভাবে? অন্যদিকে রেজিস্ট্রেশনের ফরম ফিলআপ। কোথায় ফরম ফিলআপ করব? কোথায় টাকা দেব? কত টাকা দেব? এগুলোর বিষয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ঠিকভাবে জানি না! কিছুদিন যাবৎ খুব মেন্টালি চাপে আছি।’
এ শিক্ষার্থীর প্রতিবাদে দুটি বিষয় উঠে এসেছে। একটি অ্যাসাইনমেন্ট–সংক্রান্ত এবং আরেকটি ফরম পূরণসংক্রান্ত। আমাদের অ্যাসাইনমেন্টের শিরোনাম ও নির্দেশক তৈরির দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে অসীম মেধাবী। তাঁদের অসীম মেধা দিয়েই তাঁরা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির কাজ করছেন। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
কিন্তু আমাদের সসীম মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে সহজ-সরল শিরোনামে যদি অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে বলা হয়, তাহলে বোধ হয় খুব সহজেই তারা লিখতে পারবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি। শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
আমাদের ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা কলেজে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মহতী উদ্যোগের ফলে উপজেলাভিত্তিক কলেজগুলো সরকারি হয়েছে ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট থেকে। কিন্তু সরকারি কলেজে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়েও বেসরকারি নিয়মে বেতন পরিশোধ করে ফরম পূরণের মাধ্যমে কলেজে তাদের শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটেছে!
শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কপালে সরকারি সুযোগ-সুবিধা জুটল না! আত্তীকরণের কাজের ধীরগতির কারণেই শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। এ ক্ষেত্রে দ্রুত আত্তীকরণের কাজ শেষ করে শিক্ষার্থীদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মহতী উদ্যোগের শতভাগ বাস্তবায়ন করা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে এখন সময়ের দাবি।
আবারও শিরোনাম প্রসঙ্গে আসা যাক। এমন কোনো বিষয় বা শিরোনাম দেওয়া ঠিক নয়, যা একজন শিক্ষার্থীর বুঝতে সমস্যা হয়। সাধারণত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে আগে কখনো অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন ছিল না। এমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি ও অনার্স স্তরেও অ্যাসাইনমেন্টের ওপর মূল্যায়নের কোনো অতীত রেকর্ড জানা নেই।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনার্স-মাস্টার্স স্তরে অ্যাসাইনমেন্টের ওপর মূল্যায়ন ছিল, যা এখনো অব্যাহত আছে। তাই আমাদের অনেক শিক্ষকের ক্ষেত্রেও এটা একটি নতুন বিষয়। তা ছাড়া অ্যাসাইনমেন্টের ওপর কোনো প্রশিক্ষণেরও সুযোগ হয়নি। এ অবস্থায় সহজ-সরল শিরোনামের দ্বারা ভয় নয় বরং উৎসাহ–উদ্দীপনা নিয়ে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট তৈরিতে মনোনিবেশের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া একান্ত জরুরি।
তথ্য সূত্রঃ প্রথম আলো (অ্যাসাইনমেন্টের শিরোনাম সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়)
প্রতি সপ্তাহে সকল স্তরের অ্যাসাইনমেন্ট সংক্রান্ত সকল তথ্য পাওয়ার জন্য বাংলা নোটিশ এর ফেসবুক পেজটি লাইক এবং ফলো করে রাখুন ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে রাখুন এবং প্লেস্টোর থেকে অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড করে রাখুন।
Leave a comment